রোববার , ১১ মে ২০২৫
Sunday , 11 May 2025
১৩ জ্বিলকদ ১৪৪৬

প্রিয়জিৎ দেবসরকার 

প্রকাশিত: ২১:১৩, ২৩ এপ্রিল ২০২৫

রোহিঙ্গা জঙ্গিদের দিয়ে বাংলাদেশকে অস্থির করতে চায় পাকিস্তান

রোহিঙ্গা জঙ্গিদের দিয়ে বাংলাদেশকে অস্থির করতে চায় পাকিস্তান

রোহিঙ্গা জঙ্গিদের দিয়ে বাংলাদেশকে অস্থির করতে চায় পাকিস্তান

পাকিস্তানি গুপ্তচর সংস্থা ইন্টার-সার্ভিসেস ইন্টিলিজেন্স বা আইএসআইয়ের প্রত্যক্ষ মদদে রোহিঙ্গারা বাংলাদেশকে অশান্ত করতে চাইছে। আরাকান রোহিঙ্গা স্যালভেশন আর্মি বা আরসা প্রধান আতাউল্লাহ ওরফে আবু আম্বার জুনুনীকে সামনে রেখে পাকিস্তানি গুপ্তচররাই রোহিঙ্গাদের মাধ্যমে বাংলাদেশ ও ভারতে চালাতে চাইছে মৌলবাদী কার্যকলাপ।আতাউল্লাহ সম্প্রতি ধরা পড়েছে।শোনা যাচ্ছে যুক্তরাষ্ট্রের চাপেই তাকে গ্রেপ্তার করতে বাধ্য হয়েছে অন্তর্বর্তীকালীন সরকার।

জুনুনীর জন্ম ১৯৭৪ সালের ১ জানুয়ারি, পাকিস্তানের করাচিতে। তার বাবা মৌলভি গুলাম শরিফ মিয়ানমার থেকে গিয়ে করাচির কোরাঙ্গিতে বসবাস শুরু করেন। জন্মসূত্রে রোহিঙ্গা গুলাম শরিফের আরেক ছেলে ফরিদ ফইজুল্লাহও জিহাদি হিসাবেই পরিচিত।তার নাগরিকত্ব পাকিস্তানের। মিয়ানমার-থাইল্যান্ড সীমান্তের ম্যাসট, টক প্রভৃতি প্রদেশে জঙ্গিদের প্রশিক্ষণ দিতেন সে। তার সঙ্গেও আইএসআইয়ের যোগাযোগ ছিল।   
জুনুনী এক সময় সৌদি আরবে বসবাস করতো। মক্কা থেকে ইসলামিক শিক্ষা গ্রহণ করে রাখাইন প্রদেশে শুরু করে জঙ্গি ততপরতা। ১৯৮৯ সালে সে অস্ত্র প্রশিক্ষণ নেয় আফগানিস্তানে।২০১২ সালে আরাকান অশান্ত হতেই ফের পাকিস্তানে চলে যায় জুনুনী।সেখানে ৬ মাসের গেরিলা প্রশিক্ষণ নেয় লস্কর ই তৈবার কাছে। রোহিঙ্গাদের জন্য থাইল্যান্ড ও মালেশিয়াতেও প্রশিক্ষণ কেন্দ্র খুলেছিল সে। 

২০১৩-১৪ সালে ফের রাখাইন প্রদেশে শুরু হয় তার কার্যকলাপ।পাকিস্তান ও সৌদি যোগাসূত্রকে কাজে লাগিয়ে আন্তর্জাতিক জিহাদিদের সঙ্গে নিয়মিত যোগাযোগ রাখতো সে। হরকত-উল-জেহাদ উজবেকিস্তান থেকে শুরু করে বিভিন্ন আন্তর্জাতিক জঙ্গি সংগঠনের মদদ পায় সে। তার সঙ্গে সরাসরি আর্থিক সম্পর্ক ছিল পাকিস্তান,আফগানিস্তানসহ অন্যান্য দেশের।ইসলামিক মৌলবাদে অনুপ্রাণিত জুনুনী আইএসআইএস, আল কায়দা, তালিবান সকলের সঙ্গেই যোগাযোগ রাখতো। ২০১৬ সালের ৯ অক্টোবর সে আকা মুল মুজাহিদিন জঙ্গি দল গঠন করে হামলা চালায় মিয়ানমার সেনার মাউংডাউং জেলা ছাউনিতে।জুন্টা সরকারের পাশাপাশি ও মগদের বিরুদ্ধেও তাদের হামলা চলে।জুনুনীর সঙ্গীরাও ছিল বেশ নামজাদা জঙ্গি। তার ছোটবেলার বন্ধু হচ্ছে হারাক্কা আল ইয়াকিনের আমির আবুল কালাম হায়দারী। হায়দারীর জন্ম সৌদিতে।পাকিস্তান থেকে মেলে তার জঙ্গি প্রশিক্ষণ। জন্মসূত্রে সে রোহিঙ্গা। 
জুনুনী ২০১৭ সালের ২৯ মার্চ তৈরি করে আরাকান রোহিঙ্গা স্যালভেশন আর্মি বা আরসা। গ্লোবাল রোহিঙ্গা সেন্টার তাদের অস্ত্র ও সামরিক প্রশিক্ষণ দিয়ে সাহায্য করে। 
কট্টর জঙ্গি জুনুনীকে ১৮ মার্চ নারাযণগঞ্জ ও সিদ্ধিরগঞ্জে তল্লাশি চালিয়ে গ্রেপ্তার করে র‌্যাব।তার সঙ্গে আরও ৫ জঙ্গিও অস্ত্রসহ ধরা পড়ে। বেআইনি অনুপ্রবেশ ও জঙ্গি কার্যকলাপে যুক্ত থাকার অভিযোগ রয়েছে তাদের বিরুদ্ধে। অনেকেরই অনুমান যুক্তরাষ্ট্রের চাপেই গ্রেপ্তার হয়েছে এই কূখ্যাত জঙ্গিনেতা। পাকিস্তানি গুপ্তচর বাহিনীর এজেন্ট হিসাবে সে বাংলাদেশে অশান্তি চালাতে সচেষ্ট ছিল।যুক্তরাষ্ট্রের জাতীয় গোয়েন্দা পরিচালক তুলসী গ্যাবার্ড এবং আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সংস্থা ‘ফর্টিফাই রাইটস’ চাপ সৃষ্টি করেছিল জুনুনীকে গ্রেপ্তারের জন্য।বাংলাদেশে রোহিঙ্গা বিদ্রোহী সদস্যরা মিয়ানমার থেকে আসা শরণার্থীদের হত্যা, অপহরণ, নির্যাতন ও হুমকি দিচ্ছে, যা যুদ্ধপরাধের শামিল হতে পারে বলে মনে করে ফর্টিফাই রাইটস। জুনুনী গ্রেপ্তারের পর আরসার দায়িত্ব পায় তারই ডান হাত বলে পরিচিত ওস্তাদ খালেদ।জুনুনীর সঙ্গে পাকিস্তানি যোগসাজস বহু আগে থেকেই স্পষ্ট হচ্ছিল।পাকিস্তানি নাগরিক মুহাম্মদ আল, ওরফে আবু সালমান তাকে কক্সবাজার ও বান্দারবনে ক্যাম্প করতে সাহায্য করার জন্য পাঠিয়েছিল।সে তখন  মিয়ানমার-বাংলাদেশ সীমান্তে জঙ্গি ঘাঁটি তৈরিতে ব্যস্ত ছিল।তৈর নেতৃত্বে আরসার জঙ্গিবাদী কার্যকলাপ নতুন কিছু নয়। ২০১৯ সালের সেপ্টেম্বরে জাতিসংঘের ৭৪ তম সাধারণ অধিবেশনেও আরসার সঙ্গে আইএসআইএস, আল কায়দা, তেহেরেক-ই-তালেবান পাকিস্তান জঙ্গিদের মদদের কথা উল্লেখ করেছিল মিয়ানমার সরকার।জন্মসূত্রে পাকিস্তানি রোহিঙ্গা তথা সাবেক হুজি আরাকান কমান্ডার আবদুল হামিদও ছিল জুনুনীর খুবই ঘনিষ্ট। সে বর্তমানে সৌদিতে রয়েছে। ২০২৩ সালে নিহত আবদুল কুরদুস বুর্মির সঙ্গেও যোগাযোগ ছিল জুনুনীর।লস্কর ই তৈবা ও আইএসআইয়ের সঙ্গে সংযুক্ত রোহিঙ্গা ইসলামিক মাহাজকেও এক সময় নেতৃত্ব দেয় জুনুনী।তার এই জঙ্গিবাদী কার্যকলাপে অর্থায়ণ করে পাকিস্তানের জামায়াত উদ দাওয়ার শাখা সংগঠন ফালহা-ই-ইনসানিয়েত ফাউন্ডেশন এবং পাকিস্তানি জইশ লস্করের আল খিদমত ফাউন্ডেশন। 

৫ই আগস্ট শেখ হাসিনার বিদায়ের পরে আইএসআইয়ের সঙ্গে আরসার ঘনিষ্ঠতা আরও প্রকট হয়। ডিসেম্বরে তারা একাধিক বৈঠক করে। আইএসআইয়ের উদ্যোগেই  আর্সা, রোহিঙ্গা সলিডারিটি অর্গানাইজেশন, আরাকান রোহিঙ্গা আর্মি ও রোহিঙ্গা ইসলামি মাহাজ-এর জোট গঠিত হয়। সেই জোটের সভাপতি নির্বাচিত হয় জুনুনী নিজেই। কুতুপালং রোহিঙ্গা ক্যাম্পে আইএসআইয়ের উদ্যোগে এই জোট গঠনের আসল উদ্দেশ্য হচ্ছে ভারত ও বাংলাদেশে মৌলবাদের প্রসার।আরসা সশস্ত্র গোষ্ঠীটি হারাকাহ আল ইয়াকিনের সঙ্গেও সম্পর্কযুক্ত।আরসার প্রতিষ্ঠাতা আতাউল্লাহ আবু আম্মার জুনুনী ওরফে হাফিজ তোহার সঙ্গে যোগাযোগ রয়েছে বাংলাভাই-সহ জেএমবি, হরকাতুল জেহাদ, হিজবুত তাহরীর ইত্যাদি মৌলবাদী সংগঠনের। তাই নিরাপত্তা বিশ্লেষক মেজর জেনারেল (অব.) আব্দুর রশিদ বহুদিন আগেই বলেছিলেন, ‘পাকিস্তানের গোয়েন্দা সংস্থা আইএসআই সবসময় বাংলাদেশ নিয়ে নেতিবাচক কাজ করে থাকে। আরসা প্রধান আতাউল্লাহ পাকিস্তানি হওয়ায় এ এলাকায় অস্থিরতা সৃষ্টি করতে বিশেষ সহায়ক। আইএসআই তাদের অস্ত্র ও অর্থ দুটোই সরবরাহ করছে’।পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে কাউন্টার ইন্টিলিজেন্স বাড়ানোর পরামর্শ দিয়েছেন এই নিরাপত্তা বিশ্লেষক। শেখ হাসিনার শাসনামলের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামালও  স্বীকার করেছিলেন, ‘রোহিঙ্গারা দিন দিন বিষফোঁড়া হয়ে যাচ্ছে। আমরা পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনার সর্বাত্মক চেষ্টা করছি’। কিন্তু তারা নিজেরাই এখন ক্ষমতাচ্যুত।তাই আইএসআইয়ের মদদে জঙ্গি কার্যকলাপ বাড়ছে রোহিঙ্গা শিবিরে।এই অবস্থায় জুনুনীর গ্রেপ্তার কিছুটা হলেও স্বস্তি দেবে বাংলাদেশকে। 

প্রিয়জিৎ দেবসরকার 
লেখক,গবেষক ও মানবাধিকার কর্মী।
 

সর্বশেষ

জনপ্রিয়

আরও পরুন: